বিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে যে ক'জন সাধুসন্ত অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বিরাট অনন্যতার অধিকারী ছিলেন শ্রীশ্রীরামঠাকুর। শ্রীশ্রীঠাকুর পৃথিবীতে অন্তহীন ও অসহনীয় দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মানুষকে পরিত্রাণ ও রক্ষা করতে এসেছিলেন; সঠিক পথ দেখিয়ে তাদের দুঃখ দুর্দশা মুক্ত করাই ছিল তাঁর কাজ। ঠাকুরের কয়েকটি বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণীর কাহিনী এখানে বিবৃত হল-ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে তাঁর অতিমানবিক অনুভূতিতে প্রতিবিম্বিত পূর্বাশঙ্কার কথা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োজন মতো এক খন্ড জমি পাওয়ার পর তাঁর আশ্রিত ভক্তদের অনেকেরই ইচ্ছা হয়েছিল বাংলা বৈশাখ মাসে অক্ষয়তৃতীয়ার শুভ দিনে যেন কৈবল্যধাম উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর ঘোষণা করলেন যে, আশ্রম উদ্বোধন করা হবে শনিবার, ১৯৩০-এর ২৬শে জুলাই (বঙ্গাব্দ ১৩৩৭, ১০ই শ্রাবণ)। কারণ, কয়েকজন শিষ্যের অনুমান - আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যে, ১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম বিদ্রোহ হবে এবং তারপরই তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটতে থাকবে ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে ভয়াবহ সব নিপীড়নের ঘটনা। সেই কারণেই, তাঁর আশ্রিতেরা যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারে, তিনি তাই তারিখটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন।
শ্রী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা - চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কয়েকদিন পরে তিনি বাংলাদেশের ফরিদপুরে গিয়েছিলেন শ্রীশ্রীরামঠাকুরের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে এবং একদিন ভোরে তিনি প্রণাম করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে বলেন : 'চলুন, আজ রাতেই আমরা কলিকাতায় যাই'। উপেনবাবু রাজি হলেন কিন্তু ঠাকুরের প্রস্তাবের তাৎপর্য বুঝতে পারলেন না। ওদিকে, আগের দিন রাতে একজন পুলিশ ইন্স্পেকটর গুলিতে নিহত হওয়ায় শহরের পরিস্থিতি তখন অত্যন্ত অস্থির, উত্তপ্ত। পরেরদিন রাতে উপেনবাবুকে নিয়ে ঠাকুর কোলকাতায় পৌঁছে এন্টালীতে ডাক্তার নরেন ব্রহ্মচারীর বাড়িতে ওঠেন। কাকভোরে পুলিশ নরেনবাবুর বাড়িতে হানা দেয় এবং প্রত্যেককে জেরা করা শুরু করে। ঠাকুরও নিষ্কৃতি পাননি। পুলিশ উপেনবাবুকে লর্ড সিন্হা রোডের কুখ্যাত কেন্দ্রীয় দফতরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগেই উপেনবাবু বাড়ির উপরতলায় উঠে ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন। ঠাকুর তাঁকে বলেন, 'পাপ না করিলে তাপ লাগে না, আপনি ত' কোন পাপ করেন নাই; চিন্তা করিবেন না, আপনি নির্বিঘ্নে ফিরিয়া আসিবেন'। ডাক্তার নরেন ব্রহ্মচারী সঙ্গে যান। একদিনের হয়রানির পর ডেপুটি কমিশনারের সামনে হাজির করা হলে, উপেনবাবুকে দু-তিনটি প্রশ্ন করা হয়। উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হয়ে ডেপুটি কমিশনার উপেনবাবুকে অযথা অসুবিধার মধ্যে ফেলার জন্য পুলিশ অফিসারকে তিরস্কার করেন এবং বিকেল পাঁচটায় উপেনবাবু অক্ষত অবস্থাতেই নরেনবাবুর এন্টালীর বাড়িতে ফিরে আসেন। (উৎস : উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত তাঁর স্মরণে)।
১৯৩৮ সালে এক শীতের সন্ধ্যায় শ্রীহরেন্দ্রকুমার সিংহের যদুনাথ মল্লিক লেনের বাড়ির ছাদে শ্রীশ্রীঠাকুর পায়চারি করছিলেন তুলসীদাস গঙ্গোপাধ্যায়, হরেনবাবু এবং অন্যান্য কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে; তাঁর দুচোখ নিবন্ধ ছিল আকাশের সব তারার ওপর। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, "কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় যে তারাগুলি উঠেছিল সেই তারাগুলি উঠিতেছে – অনেক লোক ধ্বংস হইবে"। (উৎস : শ্রীতুলসীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে)। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছিল; ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ; অভূতপূর্ব গণহত্যা হয়েছিল;হয়েছিল অভাবিত ও অপরিকল্পনীয় ধ্বংসলীলা।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে - তিনি তখন রয়েছেন ফেণী শহরে একটা বাড়িতে - ১৯৪৫ সালে ৬ই আগষ্ট সকালবেলায় ঠাকুর হঠাৎ বিলাপ করে বলে উঠলেন 'হায়!হায়! সব শেষ হইয়া গেল'। বস্তুত, সেই অভিশপ্ত দিনটিতে হিরোশিমার ওপর ফেলা হয়েছিল পারমাণবিক বোমা। তাঁর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর তা দেখেছিলেন। আমাদের এই গ্রহে কোন ঘটনাই শ্রীশ্রীঠাকুরের চেতনা বা অন্তর্দৃষ্টির অগোচরে ঘটতে পারেনি। (উৎস : শ্রীতুলসীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে)।
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের এক শিষ্য তাঁকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য তিনি যেন কিছু সময় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় থেকে বিশ্রাম নেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের উত্তর ছিল : যে সময় চলছে তার কোন বিরাম তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তা চলছেই। তাঁর বিশ্রাম নেই। তিনি ঝোড়ো বাতাসে উড়তে থাকা একটা খড়কুটো মাত্র। নির্দ্দিষ্ট কোন একটি জায়গায় তাঁর থাকার ব্যাপারটা নির্ভর করছে সেই ঝোড়ো হাওয়ার খেয়ালখুশির ওপর। এর পরেই ১৯৪৬-এ শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা; প্রমাণিত হয় ঠাকুরের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা। (উৎস : অখিলচন্দ্র রায় রচিত শ্রীশ্রীঠাকুর)।
কোন ঘটনা ঘটার আগেই তা দেখতে পাওয়ার ও সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার শ্রীশ্রীঠাকুরের অদ্ভুত ক্ষমতা সম্বন্ধে আর একটা উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। ১৯৪৮-এ ৩০শে জানুয়ারী বিকেলে গান্ধী হত্যার সময় আগে হঠাৎ কয়েকবার বলে ওঠেন : গান্ধীর পুনর্জন্ম হবে না। (উৎস : শ্রীমতি বীণাপাণি সেনগুপ্ত রচিত প্রচ্ছন্নাবতার শ্রীরামঠাকুর প্রসঙ্গে)।