নরলীলার শেষ পর্বে, শ্রীশ্রীঠাকুর তখন ভাবতে থাকেন একটা ভালো জায়গায় একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার কথা। তাঁর এই ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করেছিলেন ঘনিষ্ঠ ভক্তদের কাছে। ভক্তরা অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খুঁজতে থাকেন কোথায় পাওয়া যেতে পারে সেই জায়গা। কিন্ত ভক্তদের নির্বাচিত জায়গাগুলো ঠাকুরের তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। অবশেষে একদিন, ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ও তার আশেপাশে অনেকগুলি জায়গা ঘুরে দেখার পর ঠাকুর যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন একটা বট গাছের নিচে, তখন নিজেই পাহাড়তলির একটা পাহাড়ের মাথায় একটা জায়গা চিহ্নিত করে দেন তাঁর আশ্রমের জন্য। পরবর্তীকালে সেই আশ্রমের নামকরণ হয় "শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম" আর বটগাছটির নাম হয় "কৈবল্য শক্তি"।
একান্ত জনবিরল সেই জায়গাটির মালিক ছিলেন শ্রী মহেন্দ্রলাল ঘোষাল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী চঁপলা দেবী ও পুত্র হাঁরাধান ঘোষাল তাঁদের শ্রদ্ধার দান হিসেবে শ্রীশ্রীঠাকুরকে জায়গাটি দিয়েছিলেন। পাহাড়টা ঢাকা ছিল ঘন জঙ্গলে আর সেখানে ছিল কিছু হিংস্র জন্তুজানোয়ার। জায়গাটা দ্রুত পরিষ্কার করার পর একটা ছোট মন্দির গড়া হলে অধিকাংশ ভক্ত চাইলেন ১৯৩০ সালের এপ্রিল বা মে মাসে একটা শুভ দিন দেখে শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম উদ্বোধন করা হোক। ঠাকুর কিন্তু ঘোষণা করলেন যে, ঊদ্বোধন হবে ১৯৩০-এর ২৬শে জুলাই এবং সেই দিনই আশ্রমের উদ্বোধন হয়েছিল যদিও সেই অনুষ্ঠানে ঠাকুর উপস্থিত থাকতে পারেননি।
১৯৩১ ফেব্রুয়ারী মাঝামাঝি (১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৫ই ফাল্গুন) শ্রীশ্রীঠাকুর মন্দিরে যান ও কয়েকদিন থাকেন। পরে আর কখনও যাননি। পরবর্তীকালে ভক্তদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মূল মন্দির, অতিথিশালা ও চারপাশের পাঁচিল তৈরি করা হয়। রাস্তাও তৈরি করা হয় জঙ্গল পরিষ্কার করে। সে-বছর (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ) দেবী দুর্গার মূর্তি উপাসনা করে দুর্গা পূজাও করা হয়। তিন বছর এ-ভাবেই পূজো হয়; তারপর আর দেবী দূর্গার মূর্তি গড়ে নয়, প্রতি বছর শ্রীশ্রীকৈবল্যধামের বিগ্রহের পাশে ঘট রেখে ঐ পূজার উৎসব পালন করা হচ্ছে।
এটি আবার পাহাড়তলির শ্রীশ্রীকৈবল্যধামের বার্ষিক উৎসবও বটে এবং এটি চলে পাঁচ দিন ধরে। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমবেত হন এবং উৎসব চলার দিনগুলিতে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ সমস্ত দিনই প্রসাদ গ্রহণ করেন। তা ছাড়া প্রতি সপ্তাহান্তে হাজার হাজার ভক্ত মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন।
ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড নামে সুপরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের পাশে কৈবল্যধাম রেল স্টেশনের খুব কাছেই শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম। ধামের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের দিগন্ত ছোঁয়া মনোমুগ্ধকর দৃশ্য; তেমনি আকর্ষণীয় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। ঐ পাশেই রয়েছে "কৈবল্য শক্তি" নামের বটগাছটি এবং "কৈবল্য কুন্ড" নামে বড় একটা পুকুর; ভক্তরা সেখানে পুণ্যস্নান করে থাকেন। পুকুরের উত্তর দিকে "গয়াঘর" নামে একটা জায়গায় শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠান করা হয়। ঠাকুর বলেছিলেন যে, এখানে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হলে ভারতবর্ষের গয়ায় কাজ করলে যে সুফল লাভ হয় তেমনটাই হবে। পরবর্তীকালে আশ্রম প্রাঙ্গণে নির্মিত করা হয় হর-গৌরী মন্দির এবং অথিতি-ভক্তদের থাকা ও অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের জন্য নতুন একটি ভবন।
শ্রীশ্রীকৈবল্যধামের উদ্বোধনের আগেই শ্রীমৎ হরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠাকুর ধামের প্রথম মোহান্ত হিসেবে মনোনীত করে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ঠাকুরের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। তিনি সেতার বাজিয়ে ভক্তিমূলক গান গাইতে ভালোবাসতেন এবং আধ্যাত্মিকতার রহস্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা উপভোগ করতেন। ১৯৩৫-এর ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর জীবনাবসান হলে ঠাকুরের নির্দেশে মোহান্ত হন শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যয়। শ্রীমৎ চট্টোপাধ্যয় পঁচিশ বছর ধরে মোহান্ত ছিলেন এবং তাঁর কার্যকালের মধ্যে তিনি শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম ও ধামের অন্যান্য সব মন্দিরের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ প্রচুর করেছিলেন। নতুন নতুন ভক্তদের নামদানের পূর্ণ অধিকার ঠাকুর তাঁকে দিয়েছিলেন।