ধর্ম বলতে ঠাকুরের নির্দিষ্ট কোন মতবাদ নাই, তিনি ভক্তদের ক) সর্বদা নামে শরণ থাকতে খ) কর্তব্য কর্ম সম্বন্ধে সচেতন থাকতে গ) দুঃস্থদের সেবা করতে ঘ) অপরের দোষ অন্বেষণ এবং কারো ওপর ক্রোধ প্রকাশ না করতে ঙ) আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করতে ইত্যাদি উপদেশ দিতেন, ইহাই তাঁর ধর্ম, মানবধর্মে বিশ্বাসী ঠাকুর সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী ছিলেন।
ধর্ম কী? ধর্ম কেন প্রয়োজন? মানবজীবনে ধর্মের গুরুত্ব বা ভূমিকা কী? এসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং এ-ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানে বহু রকম মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের বিখ্যাত উক্তি, ‘Religion is the manifestation of the divinity already in man’। (উৎস : শিকাগো থেকে ক্ষেত্রীর মহারাজকে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের চিঠি - ৩ মার্চ ১৮৯৪)
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন যে, স্থৈর্য এবং সত্য এ-দুইই হল ধর্ম। শাশ্বত এই সত্যের নাম দেওয়া হয়েছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। তিনি না থাকলে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের অস্তিত্বরক্ষা অসম্ভব। ঈশ্বর সর্বত্রই বিরাজমান শক্তিরূপে। ঠাকুরের কথা - চিরন্তন সত্য হল মানুষের একমাত্র আশ্রয়। জাতি ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষমাত্রেরই সবথেকে মূল্যবান সম্পদ হল তার দিব্য চেতনা এবং সেই চেতনার বিকাশই হল ধর্ম। মানুষের ধর্ম হোল মনুষ্যত্ব জাগরণ। ধর্ম মূলত এক ও অভিন্ন। তবে মত ও পথ হল বহু। সাধারণত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলমান ইত্যাদিকেই ধর্ম বলে মনে করা হয়; কিন্তু প্রকৃত অর্থে, এগুলি হল পূজার্চনার ভিন্ন ভিন্ন পথ বা আচরণের নানাবিধ পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলি হল বিভিন্ন সম্প্রদায় অনুসৃত বিশ্বাস ও বিধিবিধান।
সত্য ধর্মের মূর্ত প্রতীক শ্রীশ্রীরামঠাকুর অবতার সত্যনারায়ণ রূপে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিটি মানুষকে "সত্যধর্মে'র প্রতি অনুরক্ত ও আন্তরিক থাকার ও "সত্যাশ্রয়ী" হওয়ার প্রাণমাতানো আহ্বান জানান।
শ্রীশ্রীঠাকুর সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতি, সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদের অনুরূপ অনুশীলনের অনুরোধ করেন।
তাঁর মতে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও পদবীধারী সমস্ত জীবিত প্রাণীর মধ্যে একটাই সত্তা বা আত্মা বিরাজ করছে। শ্রীশ্রীঠাকুর অবশ্য হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম থেকে আসা তাঁর অনুসারীদের কখনও আপন আপন ধর্ম ত্যাগ করার কথা বলেননি। ফলে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাদের সকলের কাছেই তিনি ছিলেন আপনজন। একবার জনৈক ভক্তের একটি প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন যে, তাদের দেশ, জন্মভূমি বা জাত যাই হোক, তারা সকলেই মনুষ্যসম্প্রদায়ভুক্ত।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম প্রতিষ্ঠার পর ঠাকুর বলেছিলেন : কৈবল্যধামের চারপাশে বহু বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হিন্দু, খ্রীষ্টান, মুসলমান সাধুসন্তেরা পূজা ও ধ্যান করতে এখানে আসবেন। এখানে তীর্থযাত্রীদের সমাবেশ কুম্ভমেলার ভিড়কেও ছাপিয়ে যাবে। এটি হবে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের তীর্থক্ষেত্র। এই ধামে সংগঠিত হবে "সর্বধর্মসমন্বয়" এবং এই ধাম থেকে উৎসারিত হবে "স্বভাবধর্মের" মন্ত্র ভবিষ্যতে যা বরণ করে নেবে আমাদের এই গ্রহে বসবাসকারী সমস্ত মানুষ। ভবিষ্যতে, বিশ্বের এই ধামের মাহাত্ম্য প্রচার করতে আবির্ভূত হবেন মহাশক্তিধর এক মহাত্মা।
সকল ধর্মের প্রতীক সমন্বিত এই নকশাটি এঁকেছিলেন ভগবান শ্রীশ্রীরামঠাকুর স্বয়ং। এই প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমেই ঠাকুর যে সত্যটি স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেছিলেন তা হলো - সমস্ত ধর্মই কালক্রমে একটি মাত্র সংঘে সমন্বিত হবে এবং একমাত্র সেই মানবসংঘই চিরস্থায়ী হবে। ভগবান শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন স্বয়ং সত্যনারায়ণ, সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্মান জানানোর বিরল মহানুভবতার অধিকারী।
এক ভক্ত একসময় ভগবান শ্রীরামঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন : 'বাবা, আমরা কোন্ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত?' উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন : 'মানব সম্প্রদায়'।
আজ আমরা বাস করছি বিশ্বায়নের যুগে। কিন্তু অনেককাল আগেই অনন্ত করুণার মূর্ত প্রতীক শ্রীশ্রীরামঠাকুর স্নেহ-ভালোবাসার মহিমা প্রচারের জন্য একজন সাধারন মানুষের রূপ ধারণ করে আমাদের মধ্যে, সাধারণ মানুষের মাঝখানে, অবতীর্ণ হয়েছিলেন।