NAME
Ram thakur
Ram thakur

আবির্ভাব, শৈশব, সাধনা, জীবউদ্ধার (হিতৈষণা), বিভূতি ও ভগবদ্‌মাহাত্ম্য

Image

মানবাত্মার অবমাননা, ধর্মের গ্লানি, দুবৃত্তদের হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপে ধরিত্রী মার আকুল প্রার্থনায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যুগে যুগে নরতনু ধারণ করেন।

এমনই এক অবতারপুরুষ শ্রীশ্রীরামঠাকুর। তিনি আমাদের পরমারাধ্য 'শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথ' বা 'শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ'। ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সর্বসাধারণের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে তিনি মানবদেহ ধারণ করেছিলেন। পার্থিব জীবনের অসহনীয় যন্ত্রণা, দুঃখ, অন্যায়-অবিচার ও নীতিদূষণ থেকে মানুষকে রক্ষা তথা উদ্ধার করতে তিনি ধরাধামে এসেছিলেন। জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাদের দিয়েছিলেন সঠিক পথের সন্ধান। তাঁর দিব্যপ্রেমের পরশমণি ছুঁইয়ে আর জীবনযাপনের আদর্শ পথ প্রকট করে তিনি সাধারণ মানুষকে উন্নীত করে নিয়ে যান আধ্যাত্মিক উদ্ভাস ও ঈশ্বর-সচেতনতার অনন্যসাধারণ স্তরে। তাঁর অনুগামী ভক্তদের মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষ ছিলেন তথাকথিত 'অচ্ছুৎ' ও অন্য ধর্মাবলম্বী। তাঁরা প্রায় সকলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসেছিলেন তাঁর চৌম্বক দিব্যসত্তা, তাঁর প্রেম ও মহানুভবতা আর তাঁর মধুর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

তিনি বলতেনঃ পরমপুরুষ 'ব্রহ্ম'-কে পেতে হলে প্রয়োজন প্রভূত অধ্যবসায় এবং কোনও মহাত্মা প্রদর্শিত মত ও পথের অনুশীলন। 'সংসার' ত্যাগ করা আত্ম-উপলব্ধির একমাত্র পথ নয়। কঠোর কিন্তু নিষ্কাম কর্মসাধনায় রত থেকে আমাদের এই পার্থিব জীবনেই আমরা ভগবদ্‌ চেতনা লাভ করতে পারি শুধু 'নাম' শরণ করে।

Image

শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম স্থাপন করার পর ঠাকুর ঘোষণা করেন যে, স্বর্গের সমস্ত দেব-দেবী এখানে অধিষ্ঠিত রয়েছেন তাঁদের অখন্ড শক্তি ও আন্তরিক আশীর্বাদের সম্ভার নিয়ে; ভবিষ্যতে শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথের মাহাত্ম্য উদ্ঘাটন করতে ও কৈবল্যমুক্তি অর্জন করার জন্য ভক্তদের উদ্ধার করতে এক পরম পুরুষ আবির্ভূত হবেন। ঠাকুর ঘোষণা করেন যে, সমস্ত ধর্মের মানুষ এখানে আসবেন এবং তাঁরা আধ্যাত্মিক সাধনায় তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবেন। তিনি বলেন যে, কৈবল্যধামের মোহান্ত 'শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথ' - এর অধিকারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসাবে সম্মানিত হবেন এবং তিনি হবেন 'শ্রীশ্রীকৈবল্যধাম'-এর আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক অধিকর্তা মোহান্ত মহারাজই শ্রীশ্রীঠাকুরের নামপ্রদানের অধিকারী একমাত্র মহাজন। ঠাকুরের জীবনযাপনের পুণ্য দৃষ্টান্ত এবং তাঁর আজীবন বিতরিত অমূল্য উপদেশ ধারা থেকে মানুষ পেয়েছে আদর্শ ও পবিত্র জীবনযাপন ও ঈশ্বর অন্বেষণের সঠিক পথের সন্ধান। তাঁর অসংখ্য পত্রাবলী ও একনিষ্ঠ ভক্তদের লেখা বিভিন্ন দিনলিপির মধ্যে রয়েছে তাঁর অজস্র মূল্যবান উপদেশ। "বেদবাণী" নামক তিন খন্ডের গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে বিভিন্ন ভক্তকে লেখা ঠাকুরের চিঠিপত্র থেকে নির্বাচিত মহামূল্যবান উপদেশমালা।

শ্রীশ্রীরামঠাকুর ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় নরদেহ ধারণ করে এসেছিলেন অবিভক্ত বঙ্গদেশে। নিজের সম্বন্ধে তিনি ছিলেন একান্তভাবে প্রচারবিমুখ এবং সেই কারণে পরমপুরুষ হিসাবে খ্যাতনামা হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে মানুষ তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। তাঁর উপদেশ ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ পেতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত তাঁর চারপাশে সমবেত হয়েছেন। অবিভক্ত বাংলার মানুষ ঠাকুরের দিব্য ব্যক্তিসত্তা সম্বন্ধে জানতে পেরেছে সমসাময়িক লেখনী থেকে - কবি নবীনচন্দ্র সেন'র রচনা 'আমার জীবন' (শ্রী সেন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট) এবং কয়েকটি গ্রন্থে ও প্রবন্ধে সন্নিবিশিষ্ট শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বন্ধে কতিপয় প্রবীন ভক্তের স্মৃতিচারণ থেকে। তাঁরা সকলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাজীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন।

প্রথম পর্ব

শ্রীশ্রীঠাকুর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার প্রখ্যাত কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ছিল ১২০৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস (ইং ২রা ফেব্রুয়ারী, ১৮৬০ সন) বৃহস্পতিবার, শুক্লা দশমী তিথি রোহিণী নক্ষত্র। পিতা রাধামাধব চক্রবর্তী ছিলেন তন্ত্রসাধক ও তপস্বী, বিধিবিধানের ভক্ত একজন সজ্জন সাধু। মাতা কমলা দেবী ছিলেন সরল সাদাসিধে প্রকৃতির ধর্মাত্মা মানুষ। শ্রীশ্রীঠাকুরের দুজন বড়ভাই ছিলেন। যমজ ভাই একজন ও এক ভগিনী। অল্প বয়সেই শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। বাল্যকাল থেকেই একা থাকতে ভালবাসতেন। দেবদেবীর পূজার্চনা ছিল তাঁর অবসর বিনোদনের প্রধান উপায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ ছিল সংক্ষিপ্ত। বালক বয়সে পিতার আধ্যাত্মিক গুরু মৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চাননের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন। তিনিও তাঁকে ভীষণ ভালবাসতেন। পিতার মৃত্যুর এক বছর পরে পিতার গুরুরও জীবনাবসান ঘটে; শ্রীশ্রীঠাকুরের বয়স তখন আট। অল্প কিছুকাল পরে বৈশাখ মাসে শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিনে যা অক্ষয় তৃতীয়া নামে বিখ্যাত, অতি সূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় প্রক্রিয়ায় তাঁর দীক্ষা হয়। কয়েক বছর পরে সেই গুরুর সাক্ষাৎ দর্শন তিনি পেয়েছিলেন আসামের কামাখ্যায় এক অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে।

দ্বিতীয় পর্ব

রহস্যাবৃত হয়ে আছে শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনকাহিনির দ্বিতীয় পর্ব। কামাখ্যা থেকে গুরুর সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন আট-দশ বছর পরে। এই সময়কালে তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ও অন্যান্য স্থানে পরিভ্রমণ করেন। অল্প কিছুকাল পরেই সম্ভবত বাংলাদেশের নোয়াখালিতে গিয়ে কয়েক বছর সেখানে কাটান। বাংলাদেশের ফেণীতে গেলে সেখানে কবি নবীনচন্দ্র সেন ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হন। তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের বয়স ২৬/২৭। তারপরে আবার তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং ১৯০২-০৩ সালে পুনরাবির্ভূত হন কলকাতায়। ১৯০৩ সালে মাতার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন কালীঘাটে। তারপর কলকাতা উপকন্ঠে নামকরা গ্রাম উত্তরপাড়াতে কয়েক বছর কাটান এবং একদিন সেখান থেকে নিরুদ্দেশ হন।

তৃতীয় পর্ব

এক বছরের বেশি সময় ধরে পদব্রজে দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ করে শ্রীশ্রীঠাকুর গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন সম্ভবত ১৯০৭ সালের শেষভাগে অথবা ১৯০৮-এর শুরুতে। এই সময় থেকে তাঁর মহাপ্রয়াণ পর্যন্ত সময়কালে সংগঠিত বিভিন্ন বিপর্যয় - দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক আন্দোলন, পারমাণবিক বিষ্ফোরণ ও ইংরেজ শাসকদের দমন-পীড়ন - এসব কিছুর মধ্যেই তিনি দুর্গত মানুষজনের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিনিয়ত তাদের দিয়ে গেছেন মনোবল, ভরসা ও তাঁর আশীর্বাদ। ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে হিন্দু ও অন্যান্য সব ধর্মের মানুষের কাছে তিনি পেয়েছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। শ্রীশ্রীঠাকুর সর্বদাই জোর দিয়ে বলতেন ঈশ্বরের পবিত্র নাম বারবার জপ করে যাওয়ার শুভ পরিণামের কথা; নামজপ এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যাবতীয় অমঙ্গলের প্রতিষেধক, কালক্রমে যা আমাদের নিয়ে যায় ঈশ্বর ও অপার শান্তির লক্ষ্যে। স্বাস্থ্য দুর্বল, তবু জীবনের শেষ কয়েক বছর শ্রীশ্রীঠাকুরের মন্ত্র-মন্ত্রণা দানের মাত্রা প্রচন্ডভাবে বেড়ে যায়। শতধারায় উৎসারিত তাঁর করুণা স্পর্শ করেছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে ১৮ বৈশাখ (ইং ১ মে ১৯৪৯) অক্ষয় তৃতীয়া, নোয়াখালি জেলা অন্তর্গত চৌমুহণী শহরে শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাসমাধি হয়। চৌমুহণীর যে-স্থানে তাঁর পবিত্র দেহাবশেষ সমাহিত হয়, তাঁর ইচ্ছা মেনে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আশ্রম; নাম - 'সমাধি মন্দির'।

Best viewed in Firefox / Google Chrome / IE 9.0 or higher
© Shri Shri Kaibalyadham Jadavpur, West Bengal India, 2013.
Website Design By: DRS Tech