এই আশ্রমটির অবস্থান বাংলাদেশের চৌমুহনী বাজারের দক্ষিণ দিকে। নোয়াখালী জেলার সব দিক থেকে আসা খালগুলোর অধিকাংশই এখানে এসে মিশেছে বলে জায়গাটার নাম চৌমুহনী। চৌমুহনী বাজারটি প্রথমে খুবই ছোট একটি বাজার ছিল; কিন্তু বর্তমানে এটি বাংলাদেশের নামকরা একটি ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেসময় একটা বিদেশী পাট কোম্পানী ওখানেই তাদের ব্যবসা শুরু করে এবং তাদের ম্যানেজারদের থাকার জন্য শ্রী উপেন্দ্রকুমার সাহার একটা বাংলো ভাড়া নিয়েছিল। কালক্রমে কোম্পানীটা বন্ধ হয়ে যায় এবং দু-বছর ধরে বাংলোটা খালি পড়ে থাকে। নরলীলার অন্তিম পর্বে শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা হয়েছিল তিনি কোলাহলশূন্য, কোন জায়গায় কয়েক বছর থাকবেন এবং তাঁর সেই ইচ্ছার কথা তিনি তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রী উপেন্দ্রকুমার সাহাকে জানিয়েছিলেন। শ্রী সাহা মহাশয় ঠাকুরকে জানান যে, ঠাকুর থাকতে চাইলে তিনি চৌমুহনীতে তাঁর খালি পড়ে থাকা বাংলোতে ঠাকুরের থাকার সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। সম্মতি পাওয়ার পর শ্রী সাহা মহাশয় বাংলোটির কিছু সংস্কার করে দেন এবং তাঁর তিরোধানের দিন পর্যন্ত ঠাকুর একটানা প্রায় সাত বছর সেখানে ছিলেন; অবশ্য মাঝেমাঝে যখন তিনি বিভিন্ন স্থানে ভক্তদের কাছে যেতেন, তখন অল্প সময়ের জন্য তাঁর বাংলো-বাসে ছেদ পড়তো। অন্যথায় বাংলোতে থাকাকালীন বেশির ভাগ সময়ই সদর দরজা এবং বাংলোর প্রধান ফটকটাও বন্ধ থাকত এবং ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন না। কালক্রমে অবশ্য তাঁর দর্শন পেতে দূর দূর স্থান থেকে আসা ভক্তদের ঐকান্তিক ইচ্ছাপূর্ণ করতে মাঝেমাঝে দরজা খোলা রাখা হোত।
১৯৪২ সালের মাঝামাঝি আনুমানিক জুন-জুলাই মাসে শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর এক ভক্ত উপেন্দ্রনাথ সাহাকে কিছুদিন নিরিবিলি থাকার অভিপ্রায় জানালে উপেন্দ্রবাবু চৌমুহনীতে তাঁদের একটি বাংলো খালি পড়ে আছে এবং শ্রীশ্রী ঠাকুর দয়া করলে সেখানে সত্বর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এই সংবাদ শ্রীশ্রী ঠাকুরকে দেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের সম্মতি সাপেক্ষে উপেন্দ্রবাবু তাঁর ভাই নরেন বাবুকে সত্বর প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে বলেন এবং তিন-চার দিনের মধ্যে বাসপোযোগী করে তোলায় উপেন্দ্র বাবু শ্রীশ্রী ঠাকুরকে নিয়ে সেই বাংলোবাড়িতে উপস্থিত হন। এই সময় থেকে প্রায় সাত (৭) বছর ১৯৪৯ সালের ১ লা মে রবিবার পূণ্য অক্ষয় তৃতীয়া পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ই শ্রীশ্রী ঠাকুর ওই বাংলোতেই বাস করেছেন। অবশেষে পূণ্য অক্ষয় তৃতীয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর ভক্তদের শোকসাগরে ভাসিয়ে শ্রীদেহ ত্যাগ করেন। এরপর শ্রীশ্রী ঠাকুর বাংলোর যে ঘরে বাস করতেন সেখানেই তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয় তাঁরই নির্দেশ এবং উপস্থিত ভক্তদের সার্বিক অনুমোদনক্রমে। পরে কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইজ্ঞিনিয়ারের প্ল্যান পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরী হয় সুন্দর সুরম্য সমাধি মন্দির।
শ্রীঠাকুর সকাল সকাল উঠে পড়তেন; বারান্দায় কিছুক্ষণ শান্ত, ধীর পদক্ষেপে পায়চারী করে তিনি খবরের কাগজ পড়তেন। তবে তাঁর উপদেশ পেতে কোনও ভক্ত এলে তিনি কখনও তা দিগকে ফিরিয়ে দিতেন না। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তিনি ক্লান্তিহীনভাবে উপদেশ দিয়ে যেতেন; এমনকি অসুস্থ থাকাকালীন সময়েও। তাঁর উপদেশের বেশির ভাগ কথাই হৃদয়ঙ্গম করা আদৌ সহজ ছিল না। তা হলেও কিন্তু ভক্তরা কখনও তাঁর কাছ থেকে সরে যেতে পারতেন না-এমনই অপ্রতিরোধ্য ছিল তার আকর্ষণ।